রূপসা জমিদার বাড়ি, চাঁদপুর
নেই হাতি, নেই ঘোড়া,
নেই জমিদারি, নেই জমিদারের পাইক
পেয়াদা কিংবা লাঠিয়াল।
নেই জমিদারদের খাজনা আদায়ে অত্যাচার
নির্যাতনের কোনো ভয়ঙ্কর স্মৃতি
চিহ্ন । তাইতো
আজও সাধারণ মানুষের কাছে
অনেক শ্রদ্ধা আর ভালবাসার স্থান
রূপসা জমিদার বাড়ির অতীত
জমিদারদের।
রূপসা জমিদার বাড়ি, চাঁদপুর- View Bangladesh |
চাঁদপুর জেলার মেঘনা নদীর
উত্তর পাড়ের ঐতিয্যবাহী রূপসা
জমিদার বাড়ির কথা। জমিদারের
জমিদারি না থাকলেও এতটুকু
সম্মান আর শ্রদ্ধার কোনো
ঘাটতি হয়নি প্রজা প্রিয়
জমিদারদের প্রতি সাধারণ মানুষের।
তাইতো এই এলাকার সাধারণ
মানুষ আজো জমিদারদের পূণ্যময়
কাজগুলোর প্রশংসা করতে ভুলেন না।
মেঘনা পাড়ের সমৃদ্ধশালী অঞ্চল
চাঁদপুরের গৌরবময় ইতিহাসের সঙ্গে
জড়িয়ে আছে এই জমিদারবাড়ি
ও পরিবারের ইতিহাস। এ অঞ্চলে অত্যন্ত
ধর্মপরায়ণ, জনহিতকর কাজের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত
স্থাপনকারী ছিলেন রূপসার জমিদাররা।
জমিদারি প্রথা থাকাকালীন প্রজাদের
খাজনার টাকায় ভোগ বিলাস
না করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান,
রাস্তাঘাট, মসজিদ-মাদ্রাসাসহ অনেক
কিছুই স্থাপন করে গেছেন
তারা।
চাঁদপুর শহর থেকে ৪০
কিলোমিটার দূরে ফরিদগঞ্জ উপজেলা
সদরের পাশে রূপসা বাজারের
পশ্চিম দক্ষিণ কোনে নজর
দিলেই দৃষ্টিতে পড়বে জমিদারবাড়ির সিংহদ্বার।
পাশেই কারুকার্জ খচিত একটি মসজিদ।
মসজিদের দক্ষিণ পাশে একটি
কবরস্থান। এর প্রতিটি ফলকে
লেখা রয়েছে চিরনিন্দ্রায় শায়িত
ব্যক্তিদের সুকর্মের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা। পথ ধরে সামনে
এগুলেই চোখে পড়বে ঘাঁট
বাঁধানো দীঘি। সামনেই নজরে
পড়বে জমিদারবাড়ির ঐতিহ্যমহিত কাছারি ভবন।
প্রায় তিনশ’ বছর আগের
কথা। আঠারো শতকের মাঝামঝি
সময়ে রূপসার জমিদারদের গোড়াপত্তন।
রূপসার পূর্ব দিকে খাজুরিয়াতে
বাইশ সিংহ পরিবার নামে
এক সমভ্রান্ত ধনশালী হিন্দু পরিবার
ছিল। কালের আবর্তে তাদের
জমিদারির বিলুপ্তি ঘটলে আহম্মেদ রাজা
চৌধুরীর কৃতিত্ব ও অদম্য স্পৃহায়
রূপসা জমিদারবাড়িতে জমিদারির বীজ অংকুরিত হয়।
তিনিই ছিলেন এই জমিদারির
কর্ণধার।
তার পরেই এই এস্টেট
পরিচালনার গুরুদায়িত্ব পান মোহাম্মদ গাজী
চৌধুরী। তিনি ছিলেন এই
বংশের সর্বাপেক্ষা দানশীল ব্যক্তি। তার
মৃত্যুর পর জমিদারির দায়িত্ব
হাতে নেন আহম্মদ গাজী
চৌধুরী। প্রকৃত অর্থে মোহাম্মদ
গাজীর ছেলে আহমেদ গাজী
চৌধুরীর সময়কালেই এ জমিদার পরিবারের
বিস্তৃতি ঘটে। সাধারণভাবে জমিদার
বলতেই সাধারণ মানুষের মনে
যে, নেতিবাচক প্রতিচ্ছবি ভেসে ওঠে, আহমেদ
গাজী সে ধরনের জমিদার
ছিলেন না। প্রজাহিতৈসী এ
জমিদার তার কাজের মাধ্যমে
নিজকে একজন বিশিষ্ট সমাজসেবক
হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। দয়া ও দানশীলতাই
ছিল তার চারিত্রীক বৈশিষ্ট্য।
জন কল্যাণমূলক কাজের জন্য তিনি
অনেক জমি ওয়াকফ করে
যান। তার মধ্যে লাউতলী
দীঘির ওয়াকফ উল্লেখযোগ্য। জমিদারবাড়ির
মূল ফটকের পাশে কাছারি
ভবন, এই ভবনেই বিভিন্ন
বিচারের কাজ সম্পন্ন হতো
।
শিক্ষানুরাগী এ জমিদার অনেকগুলো
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন। তারমধ্যে রূপসা
আহম্মদিয়া উচ্চ বিদ্যালয়, রূপসা
আহম্মদিয়া সিনিয়র মাদ্রাসা, রূপসা
স্কুল উল্লেখযোগ্য। একই সঙ্গে তিনি
ছিলেন অত্যন্ত ধর্মানুরাগী। ইসলাম ধর্মের প্রচার
ও প্রসারে তিনি অকৃপণভাবে অনুদান
দিতেন। রূপসার সু-প্রাচীন
মসজিদ তিনিই প্রতিষ্ঠা করেন।
এ ছাড়াও তার জীবদ্দশায়
তিনি আরো অনেকগুলো মসজিদ
প্রতিষ্ঠা করে গেছেন।
হবিগঞ্জের লস্করপুর সৈয়দ পরিবারের ঐতিহ্যমহিত
সু-প্রাচীন সুশিক্ষিত ও সম্ভ্রান্ত এক
মুসলিম পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন
বাংলাদেশের এক সময়ের প্রধান
বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন।
আহমেদ গাজী ঐ পরিবারে
বিয়ে করেন। তাঁর কোনো
পুত্র সন্তান ছিল না।
পাঁচ কন্যা সন্তানের মধ্যে
দ্বিতীয় মেয়ে তহুরুন্নেছা চৌধুরাণী
জমিদারির উত্তরাধিকার মনোনীত হন। আহমেদ
গাজীর জীবদ্দশায় অন্যান্য কন্যা সন্তানদের মৃত্যু
হয়।
সুযোগ্য পিতার সুযোগ্য কন্যা
তহুরেন্নেছা অচিরেই তার কর্মদক্ষতার
স্বাক্ষর রাখেন। জীবন সঙ্গী
হিসেবেও তিনি মনোনীত করেছিলেন
এক সুযোগ্য ব্যক্তিত্বকে। হবিগঞ্জের দাউদ নগরের বিখ্যাত
জমিদার সৈয়দ শাহ কেরামত
উল্যার ছেলে সৈয়দ হাবিব
উল্যার সঙ্গে তিনি পরিণয়
সূত্রে আবদ্ধ হন। তহুরুন্নেছা
চৌধুরাণী রূপসাতেই ছিলেন এবং তার
স্বামী মূলতঃ জমিদারী দেখাশুনা
করতেন। তহুরুন্নেছা অন্য দশজন জমিদারের
মেয়ের মত অন্তঃপুরে অলস
জীপনযাপন করেননি। তিনি বিভিন্ন সমাজ
সেবা মূলক কাজে নিজেকে
সম্পৃক্ত রেখেছিলেন। তাঁর এ কর্মদক্ষতার
স্বীকৃতি হিসেবে তৎকালীন ব্রিটিশ
পরিবার তাঁকে ‘কায়সারে হিন্দ’’
উপাধিতে ভূষিত করেন। এ
খেতাব বিখ্যাত মহিলাদের জন্য এক দূর্লভ
সম্মান।
তহুরুন্নেছা চৌধুরাণীর এক ছেলে ও
এক মেয়ে ছিল। তার
মেয়ের অকাল মৃত্যু হয়।
সৈয়দ হাবিব উল্যার মৃত্যুর
পর তার একমাত্র পুত্র
সন্তান সৈয়দ আবদুর রশিদ
চৌধুরী জমিদারির দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
১৯০৭ সালে সৈয়দ আবদুর
রশিদ জন্ম গ্রহন করেন।
তিনি কলকাতায় পড়াশুনা করেন। উপমহাদেশের প্রখ্যাত
মণীষা লাকসামের নবাব ফয়জুন্নেছার পরিবারের
সঙ্গে তিনি বৈবাহিক বন্ধনে
আবদ্ধ হন। ঐ পরিবারের
সৈয়দ গাজিউল হকের মেয়ে
সৈয়দা আমিরুন নেছাকে বিয়ে
করেন। আহমদ গাজিউল হক
ছিলেন নবাব ফয়জুন্নেছার দৌহিত্র।
সৈয়দ আবদুর রশিদ চৌধুরীর
জীবিতাবস্থায় জমিদারি সবচেয়ে বেশি বিস্তার
লাভ করে। তিনি শুধু
জমিদারী নিয়েই ছিলেন না।
তিনি ছিলেন অত্যন্ত সমাজ
সচেতন। তৎকালীন বৃটিশ বিরোধী অন্দোলনে
সক্রিয়ভাবে সহযোগীতা প্রদান করেন। তিনি
ছিলেন বঙ্গীয় মুসলিমলীগের স্থানীয়
পর্যায়ের নেতা। তিনি তদানিস্তত
বেঙ্গল লেজির্সলেটিভ কাউন্সিলের সদস্য নির্বাচিত হন।
পূর্ব পুরুষের ঐতিহ্যের ধারাকে তিনি সমুন্নত
রাখেন। তার দয়া ও
দানশীলতার কথা এলাকাবাসী আজও
শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন।
প্রজাসাধারণ কখনই তার ক্ষমতার
রোসানলে পড়েনি। উপরন্তু তার
সর্বজনীন মানবতাবাদী আচরণের মাধমের সাধারণ
মানুষের প্রিয়ভাজন হন তিনি। তার
ফলশ্রুতিতে পাকিস্তান আমলে জমিদারী প্রথা
বিলুপ্তি হলেও সাধারণ মানুষের
কাছে তিনি প্রত্যাখ্যাত হননি।
জমিদারী প্রথা বিলোপের পর
অনেক অত্যাচারী জমিদারকেই নিগৃহীত হতে হয়েছে। সমাজ
সংস্কারক হিসেবে তার খ্যাতি
এ অঞ্চলে সর্বজনবিদিত। তিনি
একাধিক হাট-বাজার, শিক্ষা
প্রতিষ্ঠান, মসজিদ, মক্তব নির্মাণ
করেন। জনহিতকর কাজের বিরল স্বীকৃতি
হিসেবে ব্রিটিশ শাসকরা তাকে ‘খান
বাহাদুর’ উপাধিতে ভূষিত করেন।
চাঁদপুরের চৌধুরী ঘাট এবং
সংলগ্ন চৌধুরী মসজিদ রূপসা
জমিদারবাড়ির জনহিতকর কাজের একটি অনন্য
দৃষ্টান্ত। সমাজ সংগঠক সৈয়দ
আবদুর রশিদ চৌধুরী ১৯৮১
সালের ১৭ জুলাই ইন্তেকাল
করেন। শেষ হয় একটি
অধ্যায়ের।
সৈয়দ আবদুর রশিদ চৌধুরীর
দুই পরিবারে ৮ ছেলে ও
৬ মেয়ে ছিল। তার
সুযোগ্য উত্তরসুরীরা হয়তো জমিদারির উত্তোরাধিকার
হতে পারেননি, কিন্তু পারিবারিক ঐতিহ্যকে
ঠিকই ধরে রেখেছেন। তাদের
আচার আচরণের নম্রতা, ভদ্রতা
ও শালীনতা পরিবারটির প্রতি আজো সবার
আগ্রহকে ধরে রেখেছে।
সৈয়দ আবদুর রশিদ চৌধুরীর
প্রথম পক্ষের পাঁচ ছেলে
যথাক্রমে সৈয়দ আমান উল্যা
চৌধুরী, সৈয়দ নছর উল্যা
চৌধুরী, সৈয়দ কুতুব উল্যা
চৌধুরী, সৈয়দ হারুন রশিদ
চৌধুরী এবং সৈয়দ আলমগীর
হোসেন চৌধুরী। এ ছাড়া দ্বিতীয়
পক্ষের ছেলেরা হলেন- সৈয়দ
জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী, সৈয়দ
নাজমুর রশিদ চৌধুরী এবং
সৈয়দ আনিছুর রহমান চৌধুরী।
এদের মধ্যে সৈয়দ আলমগীর
হোসেন চৌধুরী বর্তমানে রূপসা
জমিদারবাড়িতে অবস্থান করেন। তিনি বলেন,
‘পূর্বপুরুষরা জমিদার ছিলেন। কারো
ওপর অত্যাচার করেননি তারা, তাই
এখনকার মানুষ আমাদের অসম্ভব
ভালোবাসেন। আমার অন্যান্য ভাইয়েরা
দেশের বিভিন্ন স্থানে সুনামের সঙ্গে
চাকরি ও ব্যবসা পরিচালনা
করেন।
এ ছাড়াও আবদুর রশিদ
চৌধুরীর নাতী সৈয়দ মেহেদী
হাছান চৌধুরী পারিবারিক ঐতিহ্যের
সুনাম অক্ষুন্ন রাখার চেষ্টা চালিয়ে
যাচ্ছেন। তিনি বলেন, সাধারণ
মানুষকে ভালোবেসে আমারদের পূর্বপুরুষরা সবকিছু উজাড় করে
দিয়ে গেছেন। তাই তো
এই অঞ্চলে রূপসা জমিদারদের
কোনো সম্মানহানি কেউ করতে পারেনি।
সবার কাছে পরম শ্রদ্ধার
স্থান রূপসা জমিদারবাড়ি।
আমরা সাধারণত জেনে এসেছি জমিদার
পরিবারের কেউ না কেউ
নির্যাতনকারী হতেন। কিন্তু রূপসা
জমিদারদের ইতিহাস পর্যালচনা করলে
দেখা যাবে, তাদের সুনাম
ছাড়া কোনো দুর্নাম ছিলো
না। এখানে হিন্দু জমিদারের
পতনের পর মুসলমান জমিদারের
পত্তন হয়। কিন্তু এই
এলাকায় সকল ধর্মের মানুষ
ছিলো শান্তিতে।
সরজমিনে জমিদারবাড়ি ঘুরে দেখা যায়,
বাড়ির অভ্যন্তরে আজো বসবাস করছে
জমিদারদের কর্মচারী হিসেবে থাকা পাইক-পেয়াদা, সৈনিকদের প্রায় ৫০টি পরিবার।
আবার তাদের অনেকেই আশে
পাশে জায়গা কিনে বসতবাড়ি
নির্মাণ করে স্থায়ীভাবে বসবাস
করছেন। নানান কারণে জমিদার
বাড়ির অনেক সম্পত্তির মালিকও
এখন তাদের প্রজা ও
কর্মচারীরা।
✺ আপনার যাত্রা শুভ আর নিরাপদ হোক- ✺ View Bangladesh
No comments